কিশোর আন্দোলন, দুর্নীতি চক্র ও ছাত্রলীগ

Passenger Voice    |    ১০:১৬ এএম, ২০২১-১১-২৮


কিশোর আন্দোলন, দুর্নীতি চক্র ও ছাত্রলীগ


আফসানা বেগম: ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লেখা প্ল্যাকার্ড ২০১৮ সালে কিশোর শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল। আজ তিন বছর পর সেই হাতে দেখা গেল, ‘দ্য কান্ট্রি ইজ আ ডাস্টকার্ট।’ যাদের ওপর দেশের ভবিষ্যতের শাসনভার ও সামাজিক পরিস্থিতি নির্ভরশীল, প্রশাসনিক প্রতারণার শিকার হয়ে তাদের ক্ষোভের মাত্রার পরিবর্তনটি লক্ষণীয়। তবে তারা এখনো কিছুর আশায় আছে বলেই হয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পিছপা হয়নি।

ওদিকে দেখেও না দেখার ভান করা সরকার সেদিকে এখনো তেমন ভ্রুক্ষেপ করেনি। কেন করেনি জানতে চাইলে স্বাভাবিকভাবে ভাবনা আসবে, বেসরকারি যানবাহন চালনার হর্তাকর্তার কাছে সরকারের দায় কি এতটাই বেশি, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করা কি সরকারের পক্ষে এতটাই অসম্ভব যে ক্লাসরুম ফেলে রাস্তায় বেরোনো শিক্ষার্থীদের অগ্রাহ্য করাটাই যৌক্তিক? করোনায় বহুদিন যে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে বসতে পারেনি, তারা কি সরকারের বোধোদয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে ক্লাসের বাইরেই অবস্থান নিয়ে থাকবে?

ছাত্ররা কদিন আগে রাস্তায় নেমেছিল গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে। হাল আমলে জ্বালানির মূল্য ২৩ ভাগ বাড়ানোর বিপরীতে সরকার পরিবহনের ভাড়া অসংগতিপূর্ণভাবে ২৭ ভাগ বাড়িয়েছে। ওদিকে সেই সুযোগে সুযোগসন্ধানী বাসমালিকেরা ছাত্রদের অর্ধেকের জায়গায় পুরো ভাড়া দাবি করে বসেছে, যা নিতান্তই অযৌক্তিক। ছাত্র ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অর্ধেক ভাড়ার প্রচলন সারা পৃথিবীতেই কমবেশি আছে। ১৯৬৯-এর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফার অন্তর্গত করে বাস-ট্রেন-লঞ্চ-স্টিমারে অর্ধেক ভাড়ার দাবি তুলেছিল। গণ-অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তা মেনে নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও অর্ধেক ভাড়ার নিয়ম বহাল ছিল। বর্তমান সরকার উন্নয়নের ধারায় নিশ্চয় তখনকার সরকারের চেয়েও নাজুক পরিস্থিতিতে নেই, যেখানে ছাত্রদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। গণপরিবহনে মোট যাত্রীর ৫-৭ শতাংশ ছাত্র। ইতিহাস বিবেচনায় অর্ধেক ভাড়া তাদের কেবল দাবি নয়, বরং অধিকার।

আন্দোলন চলাকালীন গত কয়েক দিনে নটর ডেম কলেজের ছাত্রসহ আরও তিন ছাত্রছাত্রী ও একাধিক পেশাজীবী নাগরিকের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। পেছনে তাকালে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বেপরোয়া গতিতে ধেয়ে আসা বাসের ধাক্কায় দুজন ছাত্রছাত্রী হত্যার জের হিসেবে কিশোর ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। আন্দোলনে তাদের ৯ দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশোধিত সড়ক আইন প্রণয়ন করেছিলেন। গাড়ির ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স, পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালকের বিশ্রাম, সিটবেল্টের অপরিহার্যতার মতো বিষয়গুলো নতুন আইনে স্থান পেয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই আইন বাস্তবায়নের অভাবে আজ পুনরায় তিক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাই বলা যায়, আন্দোলনকে স্তিমিত করার উদ্দেশ্যে আইনের খাতিরে আইন করা হয়েছিল। কারণ, বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে।

রাস্তায় ৩২ লাখ গাড়ির মধ্যে এখনো নিবন্ধনকৃত মাত্র ২৫ লাখ গাড়ি মেলে। এখনো রাস্তায় প্রতিদিন অপরিকল্পিত পরিবহনের চাপায় মৃতদেহ পড়ে থাকে। অন্যদিকে ছাত্রদের অর্ধেক ভাড়া আন্দোলনের মধ্যেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি একজন ছাত্রের এবং উত্তর সিটিতে একজন পেশাজীবীর মৃত্যুর কারণ হলে জানা যায়, দক্ষিণ সিটিতে ময়লাবাহী ৩১৭ গাড়ির জন্য চালক আছেন ৮৬ জন এবং উত্তরে ১৬৫টি গাড়ির জন্য ৮২ জন। এই অসামঞ্জস্য লাইসেন্স ও অভিজ্ঞতাবিহীন মানুষকে চালকের আসনে বসতে বাধ্য করে। দেখা যায়, দক্ষিণ সিটির মেয়র ছাত্রের মৃত্যুতে হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তখন কি অপর্যাপ্ত চালকের বিষয়টি তাঁর চিন্তায় আসেনি? নিজেদের প্রশাসনিক ভুলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সমাধান এভাবেই তাঁরা দীর্ঘকাল ধরে অধীন ব্যক্তিদের ওপরে বর্তেছেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ময়লা বহনকারী গাড়ি বছরে গড়ে চারজনকে হত্যা করে; আর এর অর্ধেক করে রাজধানীতে। সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত প্রশাসনিক কাঠামোর কারণেই উত্তরে-দক্ষিণে ময়লাবাহী গাড়িগুলো পথচারী হত্যার সুযোগ পায়।

আজকে ছাত্রলীগের কর্মী আঁকতে গেলে কার্টুনিস্টরা মাথায় হেলমেট আর হাতে হকিস্টিক বা লাঠি ধরিয়ে দেন। অর্ধেক ভাড়া বা নিরাপদ সড়কের ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় বসা ছাত্রদের ওপর তাঁরা যে এই বেশেই চড়াও হন! সেদিনের ছাত্রলীগ যে আজকে এমনি এমনিই ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছে, তা নয়। এর পেছনেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইন্ধন আছে। ছাত্রলীগের কর্মী যখন হত্যা বা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তখন তাঁর শাস্তি হয় কেবল তথাকথিত ‘বহিষ্কার’। দল থেকে নিষ্ক্রান্তের এই শাস্তিই যেন রূপকথার গর্দানের সমতুল্য।

যেখানে সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশের সুনির্দিষ্ট স্থানে অবস্থানসহ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো দুর্নীতিগ্রস্ত ও আইন বাস্তবায়নে অপারগ, সেখানে চালকের আসনে বসা ব্যক্তিটিকে ‘বেপরোয়া চালক’ তকমা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন করা সমস্যার সমাধান নয়। এভাবে কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে বারবার ডেকে আনার রাস্তাই প্রশস্ত করা হয়। পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করলে কিছু প্রকাশ্য-গোপন বিষয় সামনে আসে। বিআরটিএর নকল বা পরীক্ষাবিহীনভাবে লাইসেন্স প্রদানের বিশাল চক্র সেখানে দৃশ্যমান। অন্যদিকে বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী ভারী গাড়ি (বাস, ট্রাক) চালানোর লাইসেন্স নিতে কমপক্ষে তিন বছর হালকা যান চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। 

কিন্তু বাসমালিকদের নির্দেশে নকল কিংবা হালকা যানের লাইসেন্সধারী চালকই বাস-ট্রাক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। অপরিণত চালক দিন শেষে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা মালিককে বুঝিয়ে দেওয়ার শর্তে বাস-ট্রাকের চাবি হাতে পান। আর সে কারণেই তাঁরা ‘বেপরোয়া’ গতিতে অল্প সময়ে অধিক ‘ট্রিপ মারতে’ চান। এই সবকিছুই সরকারের জানা। কিন্তু সরষের ভেতরে ভূত ঢুকে যাওয়ায় তারা সদিচ্ছার অভাবে এর সমাধানে যেতে পারে না।

বেসরকারি পরিবহনের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তাই সরকার নিজের অধীনের বিআরটিসি বাসের ভাড়া ছাত্রদের জন্য অর্ধেক করার ঘোষণা দিলেও বেসরকারি পরিবহন সংস্থাগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে। উপরন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে অসংগতিপূর্ণভাবে ভাড়া বাড়ানোর অন্যায় আবদারও মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি বিনা লাইসেন্সের চালকের হাতে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় চলছে, কারণ, ট্রাফিক পুলিশ ঘুষের বিনিময়ে তাকে চলতে দিচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা ওপরওয়ালাকে প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে অবস্থানের সুযোগ পায়। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে সেখানে দাঁড়াতেই তিনি সুদসহ বিনিয়োগকৃত টাকা সুযোগ বুঝে দুর্নীতি করা দুর্বল চালকদের পকেট থেকে উঠিয়ে নেবেন। এই বিশাল চক্রের সমাধান কেবল সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেই করা সম্ভব। তাই চক্রের শেষ প্রান্তের ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানো এর সমাধান হতে পারে না।

ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন যেখানে সরকারি প্রভাবশালীদের দৃষ্টির আড়ালে থাকে, সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত হয় সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ সেই দল, যার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। 

আজকে ছাত্রলীগের কর্মী আঁকতে গেলে কার্টুনিস্টরা মাথায় হেলমেট আর হাতে হকিস্টিক বা লাঠি ধরিয়ে দেন। অর্ধেক ভাড়া বা নিরাপদ সড়কের ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় বসা ছাত্রদের ওপর তাঁরা যে এই বেশেই চড়াও হন! সেদিনের ছাত্রলীগ যে আজকে এমনি এমনিই ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছে, তা নয়। এর পেছনেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইন্ধন আছে। ছাত্রলীগের কর্মী যখন হত্যা বা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তখন তাঁর শাস্তি হয় কেবল তথাকথিত ‘বহিষ্কার’। দল থেকে নিষ্ক্রান্তের এই শাস্তিই যেন রূপকথার গর্দানের সমতুল্য। সরকারের প্রশ্রয়ের জোরে আজ তাঁরা যেকোনোখানে যেকোনো ধরনের অপরাধে যুক্ত হতে দ্বিধাবোধ করেন না।

এই তো গত বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ের জনৈক সভাপতি ভরা জনসভায় বলছিলেন, ‘নৌকার বিরুদ্ধে যদি একটা ভোটও কেউ কাটে, ওই ওয়ার্ডে পাঁচটা লাশ পড়বে, ইনশা আল্লাহ।’ তাই সরকারকে সড়ক নিরাপদ করার অনুরোধকারী ছাত্রদের দাবিও তাঁরা লাঠি দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। এই নির্যাতনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ ভবিষ্যতে সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হবেন এবং একইভাবে অবিচার আর নির্যাতন চালিয়ে যাবেন বলে আশা করা যায়। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তাঁদের উৎসাহ দিয়ে এইচ টি ইমাম একবার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘তোমরা শুধু লিখিত পরীক্ষায় বসবে, বাকিটা আমি দেখব।’ এখন যেকোনো সহিংসতায় নিজেদের দলের বলশালী প্রকাশ্য অংশটির নাম নিয়ে মন্ত্রীরা উচ্চারণ করেন, ‘ছাত্রলীগ তখন কোথায় ছিল?’ তাঁদের কথা শুনলে মনে হয় ছাত্রলীগ দেশের পুলিশ বা সেনাবাহিনীর মতোই দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তাই অসহায়-নির্বোধ কিশোরদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের ঝাঁপিয়ে পড়া হয়তো মন্ত্রীদের চোখে বেমানান হয়নি। তবে দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বোধগম্য হয় না, যে দলটি একসময় ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কথা বলত, সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাত, আজ ছাত্রদের পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্ধেক ভাড়ার উপযুক্ত দাবি হৃদয়ঙ্গম করতে সে দল ব্যর্থ হচ্ছে কেন!

বস্তুত, একচ্ছত্র ক্ষমতা কোনো না কোনো ধাপে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। ক্ষমতায় বসা মানুষ ক্ষমতা হারানোর ভয়েও দুর্নীতিতে জড়ায়। বেসরকারি গণপরিবহনের প্রভাবশালী মালিকের দুর্নীতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশকারী সরকারি সিদ্ধান্ত সেদিকেই ইঙ্গিত করে। সরকারের যদি প্রত্যেক নাগরিকের জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা করার ইতিবাচক ভাবনা থাকে, তবে তা প্রতিটি স্তরের ও নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের ব্যয় বহনের সাধ্যের মধ্যে হতে হবে।

আফসানা বেগম সাহিত্যিক 
afsanapushkin@gmail.com